দক্ষিণ যাত্রা (পর্বঃ দুই)

রাতের বেলা রেষ্টুরেন্টে থেকে খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফিরলাম। তারপর, ডিজনি ওয়ার্ল্ডের ঠিকানা গুগল করতে গিয়ে দেখি ডিজনি বাবাজি অনেকগুলো থিম পার্ক করে রাখসে। যেকোন একটায় গেলেই আমরা সারাদিনের জন্য গিট্টু খেয়ে যাব। এর উপ্রে টিকেটের দামের ব্যাপারতো আছেই। ঠিক হল আমরা যাব ডিজনির হলিউড থিম পার্কে।


সকাল দশটার দিকে পার্কে গিয়ে দেখি প্রচুর জনসমাগম। ক্রিসমসের আগের দিন এইখানে এত মানুষ কৈথেকে আসল এই চিন্তা করতে করতে ভিতরে ঢুকলাম। যে বিশাল পার্ক, সব কিছু দেখা সম্ভব হবে না। তাই ভিতরে ঢুকার সময় দেয়া ব্রোশারে চোখ বুলালাম। ঠিক করলাম, কই কই যাওয়া যায়। প্রথমে ঢুকলাম ডিজনির জীবনের উপর ছোট্ট একটা ডকুমেন্টরি দেখতে। নাম “ওয়ান ম্যান’স্‌ ড্রিম”, কেমন করে ডিজনি মিয়া ২০ডলার পকেটে নিয়া হলিউডে আইসা, পরে মিলিওনিয়ার(এখন তার কোম্পানির মোট মূল্য ৩৫ বিলিওন) হইল সেই কাহীনি আর কি। প্রচন্ড রকমের ইচ্ছাশক্তি আর মেধা থাকলে যে কি করা যায় ডিজনি তার অন্যতম উদাহরন। ডিজনিই এখন পর্যন্ত সবচে বেশি বার (২৬ বার) অস্কার পাওয়া লোক।



এরপর আমরা গেলাম “ষ্টুডিও ব্যাকলট ট্যুরে”, এই ট্যুরে দেখানো হল কেমন করে পানিতে, গানশিপে গোলাগুলির স্পেশাল ইফেক্টগুলো করা হয়। ছোট ট্রেনের মত গাড়িতে চড়িয়ে পাহাড়ের মত একটা সেটে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। তারপর সেখানে আবার গোলাগুলির ঘটনা দেখানো হল। সাথে এবার ট্রেনকেও হালকা দোলানো হলো আর একপাশ আর উপর থেকে আসলো পানির প্রবল স্রোত। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, সেই স্রোত সব কিছু ভেঙ্গে-চুড়ে আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ভাবেছিলাম ভিজে জবজবে হয়ে যাব। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেরকম কিছু হল না। গায়ে হালকা পানির ছটা লাগল এই যা।

ষ্টুডিও ব্যাকলট ট্যুর

টয় স্টোরি আমার খুব পছন্দের ফিল্ম। তাই দাড়াইলাম “টয় ষ্টোরি ম্যানিয়া”র লাইনে। প্রায় পনেরো মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে যেখানে আসলাম সেখানে দেখলাম ওয়েটিং টাইম নব্বই মিনিট। তার মানে এই খান থেকে ভিতরে ঢুকতে আরো লাগবে কমপক্ষে দেড় ঘন্টা। এতক্ষন অপেক্ষা করার টাইম নাই। তাই “গ্রেট মুভি রাইড”, “এমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট শোকেস” দেখে গেলাম “দি মাপেট শো, থ্রি ডি” দেখতে। বিশাল লাইন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে প্রথমে মোটামুটি হতাশই হলাম। সিনেমা হলে থ্রি ডি দেখার মত অত ভাল এক্সপেরি্যেন্স আশা করি নাই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ছোটো ছোটো টিভিতে থ্রিডি দেখতে হবে? কার্টুনগুলো একটা টিভি থেকে আরেকটা টিভিতে যাচ্ছে, এইটা নাকি থ্রি ডি। থ্রি ডি দেখার চশমা দিয়ে যেমন দেখা যায়, খালি চোখেও ঠিক তেমনই দেখা যায়। যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম তার উল্টা দিকের দরজা খুলে যেতেই বিরক্ত হয়ে বের হতে গিয়ে দেখি, আমরা দাঁড়িয়ে থিয়েটারের সামনে। আসলে এতক্ষন যা দেখলাম সেটা শো ছিল না, আসল শো শুরু হবে এখন। আসল শো দারুন লাগল।

বের হয়ে হালকার উপর হট ডগ মেরে দিলাম। এইটাই লাঞ্চ। পার্কের ভিতরে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে গেলে খবর আছে। এখন যাব “লাইট, মটরস, একশন” দেখতে। এই শোটা এই থিম পার্কের অন্যতম বড় আকর্ষন। গাড়ির একশনের ষ্ট্যান্টগুলো দেখানো হল এই শোতে। গ্যালারির এমন একটা জায়গায় সিট পেলাম, যেখান থেকে খুব ভাল ছবি তোলা যাবে না। শো’টা বেশ লাগল। ইন্ডিয়ানা জোন্স সিনামার সেটে গেলাম তারপর। এই শো’টাই সবচে ভাল লাগেছে আমার। দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যায় মাত্র একবারই হয় লেজার লাইট শো, নাম “ফ্যান্টাজমিক”, পানির উপর লেজার দিয়ে আলোর মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী।

লাইট, মটরস, একশন শো এর একটি মূহুর্ত
ইন্ডিয়ানা জোন্স শো এর একটি দৃশ্য
ইন্ডিয়ানা জোন্স শো
ইন্ডিয়ানা জোন্স শো
লেজার লাইট শো


সব শেষে গেলাম টোয়াইলাইট জোনে। এটা আমার সারা জীবনের অন্যতম ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ভেবেছিলাম টোয়াইলাইট মুভির কোনো সেট-টেট দেখাবে। লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের চিল্লাচিল্লি শুনে ভাবলাম হয়ত ভ্যাম্পায়ার দেখে ডরাইতেসে। যাহোক, আমাদের পালা আসলে উৎসাহ নিয়ে লিফটে উঠলাম। দেখি লিফটেই বসার সিট, আর সেই সিটে সিটবেল্টও আছে। সিট বেল্ট যখন বাধতে বললো, বুঝলাম ঘটনা আছে। যাহোক আস্তে আস্তে আমাদের দুই/ তিন তালায় ঊঠানো হল। সেখানে লেজার দিয়ে ভুত/টুত দেখিয়ে ভয় দেখানো হল। এবার লিফট আর উপরে না গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুদুর যাবার পর লিফট আর একটু উপরে উঠল। কিছুক্ষন থামল সেখানে। এবার হঠাৎ দ্রুত উঠে গেল একদম চোদ্দ তলায়। উঠে আবার থামল। আমি বুঝলাম কি ঘটতে যাচ্ছে, লিফট নিশ্চই এবার নিচে নামবে, আর নামবে অস্বাভাবিক গতিতে। আমি একটু ভীতু টাইপের। প্লেন ল্যান্ড করার সময়ই আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। যা হোক, চোখমুখ বন্ধ কইরা আল্লাআল্লা করতে লাগলাম, কইলজা শুকাইয়া কাঠ। লিফট যেমনটা ভেবেছিলাম তারচেও বেশি গতিতে নিচে নামল। আবার উপরে উঠল, আবার কোথাও গিয়ে থামল। সামনে-পেছনে গেল। আমার মনে হতে লাগল, এর বুঝি আর শেষ নাই। অনন্তকাল ধরেই এমনটা চলতে থাকবে। একসময় লিফটের গেট খুলে গেল। লিফটের অপারেটর মুচকি হেসে বলল “হোপ ইউ গায়জ হ্যাভ ফান”, আরে এইটা যদি ফান হয়, তাইলে টর্চার কোনটা? বের হয়ে দেখলাম আমার গলা ভাইঙ্গা গেসে চিল্লাইতে চিল্লাইতে। আমার বউ দেখি হাসতেসে। এইটাই নাকি ওর সবচে বেশি ভাল্লাগসে। 😦

(চলবে…)

21 Replies to “দক্ষিণ যাত্রা (পর্বঃ দুই)”

  1. দারুণ লিখেছেন। খুব ভাল লাগলো। বেশ মজাও পেয়েছি 🙂 । বিশেষ করে নিচের লাইনটি পড়ে তো খুবই মজা লেগেছে লেখার ধরণটির জন্যঃ
    “”””লিফটের অপারেটর মুচকি হেসে বলল “হোপ ইউ গায়জ হ্যাভ ফান”, আরে এইটা যদি ফান হয়, তাইলে টর্চার কোনটা? বের হয়ে দেখলাম আমার গলা ভাইঙ্গা গেসে চিল্লাইতে চিল্লাইতে।”””” 😀 😀
    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম 🙂

  2. ভাইয়া আসলেই ভীতু টাইপের।
    একদিন আব্বু ভাইয়া আর আমি ঘোড়ার গাড়িতে উঠছিলাম। ভাইয়া ভয়ে শেষ। বলে ঘোড়া জোরে দৌর দিলে যদি গাড়ি উল্টায় যায়।
    আজব…!!!

  3. তুমি যে ভয় পাইবা সেটা জানি।
    তোমার যায়গায় আমি হলে অপারেটরের মুচকি হাসি সার্থক হইতো।
    অবশ্য সে মনে হয় অনেক মজা পাইছে। সেদিক থেকে বাণী সার্থক…!!
    😉

  4. ভাইয়া দারুন লাগলো লেখাটা পড়ে। বেস্ট লাইন- ”একসময় লিফটের গেট খুলে গেল। লিফটের অপারেটর মুচকি হেসে বলল “হোপ ইউ গায়জ হ্যাভ ফান”, আরে এইটা যদি ফান হয়, তাইলে টর্চার কোনটা? বের হয়ে দেখলাম আমার গলা ভাইঙ্গা গেসে চিল্লাইতে চিল্লাইতে। আমার বউ দেখি হাসতেসে। এইটাই নাকি ওর সবচে বেশি ভাল্লাগসে।” হাহাহাহা…

নিঃশব্দতার ছন্দ… এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল